শিক্ষার গতিপথ
ফাদার পিউস গমেজ
শিক্ষার অর্থগত ব্যপ্তি অনেক। তফাৎ রয়েছে তারতম্য ও পর্যায় অনুসারে। রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা; ধর্মীয় ও কারিগড়ি শিক্ষা, পেশাধারী ও উচ্চশিক্ষা। তবে সব কিছুর মূলে যখন টাকা বা সম্পদই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় তখন শিক্ষা তো আর সবার জন্য হয়ে ওঠে না। দেখা যায় যাদের সামর্থ নেই ভাল পড়াশুনা করলেও তাদের অনেকের স্বপ্নই থেমে যায় যে কোন মুহুর্তে। আর যাদের আছে তারা বেশির ভাগ সেই প্রভাব খাঁটিয়েই বড় হতে চায়। শিক্ষায় তারা বেশিরভাগই পিছিয়ে। অনেকে এগিয়ে থাকলেও দেশ ও দশের কল্যাণে তাদের অবদান অনেক কম। অনেকে আবার হন দেশান্তরি। তবে প্রকৃত শিক্ষা হতে এদের একটা বড় সংখ্যা ঝরে পড়ছে। এক্ষেত্রে বড় একটি সমস্যা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। যার সংক্রমনে মানুষের জীবনে এমন কোন দিক নেই যে পর্যদ্যুস্ত হচ্ছে না। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের শিক্ষাব্যবস্থা স্থিতিশীল হয়নি আদৌ। অপ্রতুল অবকাঠামো, জনবল সংকট, শিক্ষক সংকট, গুণগত শিক্ষকের অভাব, পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা, শিক্ষা নীতিমালার ঘন ঘন পরিবর্তন এটাইতো নৈমিত্তিক চিত্র। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় শিক্ষা প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত গতি পথ পাল্টাচ্ছে। তা কখন কার স্বার্থ রক্ষা করছে, কার আখের গুছাতে সহায়ক হচ্ছে বলা কঠিন। তবে শিক্ষা মানুষের জন্যই। আর এ প্রক্রিয়া শুরু হয় পরিবার হতে। এর নির্দিষ্ট কাঠামোতে প্রবেশ করে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়, যা আমরা শিক্ষা ব্যবস্থা বলে থাকি। শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসৃত হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়ে। তা সরকারি বা বেসরকারি দু’ব্যবস্থাপনায়ই হতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক কাঠামো ও শিক্ষকদের আওতাধীনে মানুষ পর্যায়ক্রমে তার সকল শিক্ষাই গ্রহণ করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনের সাথে বেশ কয়েকটি দিক অনেক প্রভাব ফেলে। এগুলো হলো অভিভাবকদের দায়িত্বশীলতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকাঠামো, নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকবৃন্দ ও শিক্ষার্থীবৃন্দ। এই দিকগুলো পারস্পারিক যোগাযোগ রক্ষা করে সুন্দরভাবে শিক্ষা সেবার সাথে জড়িত থাকে, তবে স্কুলগুলোতে লেখাপড়াও হবে আর শিক্ষার্থীরা মানুষ হবার দীক্ষা নিয়েই বড় হতে থাকবে। ১. অভিভাবক হিসাবে প্রধান দায়িত্ব হলো সন্তানের পড়াশুনার নিয়মিত খোঁজ-খবর নেওয়া। ৪ বা ৫ টি প্রাইভেট পড়িয়ে কিংবা ভাল স্কুলে ভর্তি করেই খান্ত দেয়া উচিৎ নয়। ক্লাস ও বইয়ের পড়া শিক্ষার্থীকে নিয়মিতভাবে আত্মস্ত করতে হয়। না হলে এক সময় যত ভাল বা পড়–য়া শিক্ষার্থীই হোক না কেন অচিরেই বই বিমুখ হবে। আরও দরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করা। জেনে নেওয়া সন্তানেরা সঠিক সময়ে স্কুলে প্রবেশ করছে কিনা। কাদের সাথে সময় ব্যয় করে। কি ক’রে অবসর সময়ে। ক্লাসে নিয়মিত পড়া দিচ্ছে কিনা। না দিয়ে থাকলে কারণ কি তা জানার চেষ্টা করা এবং তা নিয়ে শিক্ষকদের সাথে কথা বলা। পিতামাতা হিসাবে অভিভাবকদের অবশ্যই পারিবারিক আদর্শিক জীবন যাপন করা অনেক দরকার। এতে করে শিক্ষার্থীরা অনুগত হতে অনুপ্রেরণা ও শিক্ষা পায়। টাকা পয়সা সহজে হাতে আসলে জীবনটাও অতি সস্থা হয়ে যায়। এজন্য সচেতনভাবে সন্তানের প্রয়োজনগুলো দেখতে ও মেটাতে হয়। ২. অভিভাবকগণ অনেক আশা নিয়ে ও বিশ্বাস রেখে তাদের সন্তানদের তুলে দেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। জীবন গড়ার জন্য যা কিছু প্রয়োজন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার সবটুকুই দিতে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মিলন ও সাক্ষাৎ গৃহ। এখানে জীবনের সাক্ষাৎ ঘটে জীবনের প্রয়োজনে। আর এ প্রয়োজন হলো শিক্ষা-দীক্ষা ও আচরণে বড় করে তোলার। পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের মূলনীতি, কর্মকাঠামো, শিক্ষার পরিবেশ, মিশন ও ভিশন, নীতি-নৈতিকতা ও সম্পর্ক; মূলত এসবের উপরই নির্ভর করে শিক্ষার মানদÐ ও অর্জন। ৩. শিক্ষক হিসাবে শিক্ষাক্ষেত্রে তাদেরকেই অনেক মূখ্য ভ‚মিকা পালন করতে হয়। এজন্য একজন সার্থক শিক্ষক হয়ে ওঠার জন্য প্রতিনিয়ত উপযোগী লক্ষ্য নির্ধারন করতে হয়। যোগাযোগে স্বচ্ছতা ও আদর্শিক জীবনাচরণ একজন শিক্ষকের মূল শক্তি। যেকোন পরিবর্তিত বাস্তবতায় খাপ-খাওয়ানো ও গ্রহণীয় মনোভাব থাকা যেকোন শিক্ষকের জন্যই একটি বড় গুন। পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকগণ কতটা দায়িত্বশীল ও আন্তরিক শিক্ষার্থীগণ সহজেই বুঝতে পারেন। এজন্য পাঠ প্রস্তুতি নেওয়াটা আবশ্যিকতার মধ্যেই পড়ে। আত্ম-মূল্যায়ন একজন মানুষের কর্মক্ষেত্রে তার মনোবল অনেক দৃঢ় করে। যা কর্ম স্পৃহা বৃদ্ধির পাশাপাশি একজন শিক্ষককে আরও জ্ঞান পিপাসু করে তোলে। মানুষ হিসাবে আমরা যা করে বেঁচে থাকি তা ঘিরেই আমাদের ভালবাসা বা মানসিক দূর্বলতা তৈরি হয়। এক্ষেত্রে প্রতিজন শিক্ষকই জ্ঞানানুরাগী হিসাবে শিক্ষার্থীদের ঘিরে তাদের স্বপ্নগুলোকে লালন করেন। কাজ বা সেবার স্বচ্ছতা দিয়েই তারা একাজে আনন্দ পান এবং কখনও এর জন্য তাৎক্ষণিক প্রতিদান প্রত্যাশা করেন না। শিক্ষকদের পরিচয় ও দায়বদ্ধতা অক্ষুন্ন থাকে শিক্ষার্থীদের কথা ও সমস্যা ধৈর্য্যরে সাথে শ্রবণের মধ্য দিয়েই। এইভাবে একজন ইতিবাচক মনোভাবের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে স্থান করে নেন। শিক্ষার্থীদের জীবনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী বা স্থায়ী সাফল্য যেন আসে সে প্রত্যাশায় শিক্ষকগণ আপ্রাণ চেষ্টা করে যান। শিক্ষকগণ সাধারণত উদার মনের মানুষ। অন্যের প্রশংসা করা ও উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে তারা অনন্য। চেলেঞ্জ গ্রহণ করে তারা অন্যের সন্তানকে গড়ে তোলার ব্রত গ্রহণ করেন। অভিভাবকদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করে শিক্ষকগণ একযোগে কাজ করে যান। ভাষা ব্যবহারে অনেক সুসংহত, মার্জিত ও ভদ্র। কর্মে আনন্দপ্রিয় শিক্ষকগণ শ্রেণিকক্ষের সৃজনশীল পরিবর্তনের নিয়ামক। নতুনত্ব নিয়ে প্রাণের সঞ্চার ঘটানো ও শিক্ষার্থীদের পাঠ মনোযোগি কিভাবে করতে হয় তা শিক্ষকগণ ভাল জানেন। নিজের নিয়ত্রিত জীবন ও শিক্ষার্থীদের অতিমাত্রার ক্ষতিকর আবেগের প্রকাশগুলো গঠনমূলক পন্থায় নিয়ন্ত্রণ করে শিক্ষকগণ প্রকৃত অর্থেই জীবনের পরিচালক হয়ে উঠেন। শিক্ষকগণ সত্যের সাধক ও শিক্ষার্থীদেরকে সত্যের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এজন্য জবাবদিহিতায় তারা ভীত নন। শিক্ষার্থীরাও এজন্য তাদের শিক্ষকদের গুরুজন বলেই মান্য করে। প্রকৃত শিক্ষাদাতা হিসাবে উদারভাবেই শিক্ষকগণ শ্রেণি কক্ষে, প্রয়োজনে শ্রেণিকক্ষের বাহিরেও শিক্ষা দিয়ে থাকেন। বিষয়ভিত্তিক দক্ষ শিক্ষকগণ ছাত্রদের সর্বদা অসীমতার দিকে পথ নির্দেশ করেন। শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকদের এই নির্দেশনা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে জীবন সমরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৪. একজন শিক্ষার্থী বা ছাত্র সু-শৃঙ্খল জীবনের পথিক হবে সেটাই স্বাভাবিক। না হলে জ্ঞানের প্রতি তৃষ্ণা জাগ্রত হবার সম্ভাবনা কখনোই আসবেনা। নিয়মানুবর্তীতা, পরিশ্রম, সময়ের সঠিক ব্যবহার ও অধ্যবসায় একজন শিক্ষার্থীকে তার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে অনেক সাহায্য করে। বাধ্যতা একজন শিক্ষার্থীকে সু-শৃঙ্খল জীবন গড়ে তুলতে অনেক সাহায্য করে। শিক্ষকদের সাথে সুন্দর, শ্রদ্ধাশীল সম্পর্ক ও যোগাযোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের ভবিষ্যত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করে থাকে। সঠিক দিক নির্দেশনা গ্রহণ করে জীবনের ভুলগুলো সংশোধন করে থাকে। এভাবে শিক্ষার্থীরা সামনে এগিয়ে যাও দিনে দিনে ভবিষ্যত স্বপ্নের ভিত্তি রচনা করে। স্থিতিশীল হোক দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষাঙ্গনে গড়ে উঠুক সুস্থ্য পরিবেশ। মানবিক মূল্যবোধ ও পেশাগত দায়বদ্ধতার দীক্ষায় বেড়ে উঠুক প্রতিটি মানুষ। শিক্ষা হোক সত্য লালনের, মানব ও জগত কল্যাণের সাধনাগৃহ।